প্রিন্টঃ ২৬ অক্টোবর ২০২৫
দরবেশের মুরিদ হিরু সিন্ডিকেটের কবলে পুঁজিবাজার, গায়েব ৮৫ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমআইএ)-এর দাবি, পুঁজিবাজারের ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন।
ডেইলি সান রিপোর্ট, ঢাকা
প্রকাশঃ ১৯ মে ২০২৫
শেয়ার করার বিকল্পগুলি
‘বড় হয়ে আমরা কেউ পুঁজিবাজারে যাব না। পুঁজিবাজারে গেলে মানুষ ফকির হয়’- এভাবেই প্রতিদিন চার সন্তানকে পড়ার টেবিলে শপথ করান আমিনা খাতুন। তাঁর স্বামী সাইফুল আলম, ধানমণ্ডির ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী, পুঁজিবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ও ফোর্সড সেলের কারণে সাইফুল আলমের মতো বহু বিনিয়োগকারী আজ নি:স্ব। অন্যদিকে, আবুল খায়ের হিরুর মতো কারসাজির মূলহোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুঁজিবাজারের ‘দরবেশ’ খ্যাত সালমান এফ রহমানের কারসাজির অন্যতম সহযোগী এই হিরুর কালো ছায়া যেন পুঁজিবাজার থেকে সরছেই না।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমআইএ)-এর দাবি, পুঁজিবাজারের ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন। সংগঠনটি আরও জানায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজার মূলধন প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
লোটাস কামাল-দরবেশ-শিবলী রুবাইয়াতের সিন্ডিকেট: স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশের শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে সালমান এফ রহমান, লোটাস কামাল, শিবলী রুবাইয়াত ও আবুল খায়ের হিরু ছিলেন একে অপরের সহযোগী। তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কারসাজিতে সিএমসি কামালের সঙ্গে লোটাস কামালও জড়িত ছিলেন।
অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই জোটের কেউই শাস্তির মুখোমুখি হননি। ফলে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শেয়ারবাজারে সর্বনাশের পেছনে এই দুই জুটির কারসাজিই মূল কারণ। নিয়ম-কানুনকে উপেক্ষা করে তাঁদের অবাধ লুটপাট অব্যাহত থাকে। এই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নি:স্ব হয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী, লোপাট হয়েছে তাঁদের পুঁজি।
বিগত ১৫ বছরে শেয়ার কারসাজি ও জালিয়াতির আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে এসব নাম। বাজার কারসাজিতে সহায়তার জন্য তাঁরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছেন। এই চক্র সম্মিলিতভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।
দরবেশের মুরিদরা এখনো সক্রিয়: বিএসইসির অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সদস্য ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে অনেক তথ্য বেরিয়ে এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। সেই ‘দরবেশ, পীররা’ বহাল তবিয়তে পুঁজিবাজার চালিয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা না থাকলেও তাঁদের অনুসারীরা এখনো সক্রিয় রয়ে গেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নাম যুগের পর যুগ ধরে পুঁজিবাজারের কারসাজির সঙ্গে সমার্থক হয়ে আছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েও তাঁর বিচার হয়নি। ১৯৯৬ সালের ভয়াবহ ধসের নেপথ্যে জুলাই থেকে ডিসেম্বরে জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সালমান এফ রহমান ও তাঁর কোম্পানি জড়িত ছিল বলে বিএসইসির তদন্তেও উঠে এসেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘদিন মন্দার কারণে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী বড় ধরনের লোকসানের মুখে। সালমানপন্থী একটি গোষ্ঠী বাজারে বিক্রির চাপ তৈরি করে পতন ত্বরান্বিত করছে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অস্থির হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৪২৬ পয়েন্টে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা আশার আলো দেখলেও, গত বছরের ১১ আগস্ট সূচকটি বেড়ে ৬০১৬ পয়েন্টে দাঁড়ালেও এরপর ফের পতন শুরু হয়। সর্বশেষ গত রবিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২৯.৩৮ পয়েন্ট কমে ৪৭৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনও তলানিতে, মাত্র ২৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে সূচকটি ১২২৫ পয়েন্ট হারিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে পুঁজিবাজারের দরপতন আরও তীব্র হচ্ছে।
কে এই হিরু: আবুল খায়ের হিরু শেয়ারবাজারে একজন আলোচিত সরকারি কর্মকর্তা, যিনি শেয়ার কারসাজি করে রাতারাতি বড় বিনিয়োগকারী বনে যান। সমবায় ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনি কোনো শেয়ার কিনলে অন্য বিনিয়োগকারীরাও তাঁকে অনুসরণ করেন, কারণ তাঁরা জানেন সেই বিনিয়োগ লাভজনক হবে।
সমবায় অধিদপ্তরের উপরেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরু নিজের নামে ও আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সদস্য এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামে একাধিক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, শেয়ার দর কারসাজির প্রতিটি অভিযোগের শুনানিতে হিরু তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি জমা দিতেন।
সাবেক শিবলী কমিশনের সময়কালে আবুল খায়ের হিরু ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। ডজনের বেশি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে বিএসইসি ২০২২ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে হিরু ও তাঁর সহযোগীদের জরিমানা করে। জরিমানা পরিশোধ না করায় তাঁদের বিরুদ্ধে চারটি মামলাও করা হয়েছে।
বিএসইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিরু ও তাঁর সহযোগীরা গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স, ঢাকা ইনস্যুরেন্স, এশিয়া ইনস্যুরেন্স, ফরচুন সুজ, ওয়ান ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, বিডিকম অনলাইন, আইপিডিসি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স, জেনেক্স ইনফোসিস, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সসহ আরও কিছু কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত ছিলেন।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা চলছে, তাই দরপতন হচ্ছে। মন্দা বাজারেও কারসাজি থামেনি। কারা কারসাজি করছে তা বিএসইসি ভালো জানে। ব্যবস্থা না নিলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারও কারও জড়িত থাকার সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।
অভিনব উপায়ে কারসাজি: সর্বশেষ গত ১৫ মে পুঁজিবাজার কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবুল খায়ের হিরু ও তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ ১৩ জনের সিন্ডিকেটকে ২৯ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। সাকিবকে জরিমানা করা হয় দুই কোটি ২৬ লাখ টাকা।
বিএসইসির এপ্রিল মাসের ‘এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, জরিমানার সম্মুখীন হওয়া অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: কাজী সাদিয়া হাসান, আবুল কালাম মাতব্বর, ডিআইটি কো-অপারেটিভ, কাজী ফরিদ হাসান, কাজী ফুয়াদ হাসান, কনিকা আফরোজ, সাজেদ মাতব্বর, মোহাম্মদ বাশার, মোনার্ক হোল্ডিংস, মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, সফটাভিয়ন এবং জাভেদ এ মতিন।
বিএসইসির তদন্তে বলা হয়েছে, এই চক্রটি সোনালী পেপারের শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ১২৬ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৯৫৭.৭০ টাকায় পৌঁছায় এবং ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মুনাফা তোলে ও আরও ৫৫ কোটি টাকার অবাস্তবায়িত লাভের সম্ভাবনা তৈরি করে। হিরু কমিশনের কাছে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে সাকিবের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে শেয়ার লেনদেনে আরও সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
এর আগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর কারসাজির দায়ে হিরু, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানকে ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতব্বরকে সর্বোচ্চ ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, হিরুকে ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ২৭ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তেও শেয়ারবাজারে কারসাজি ও অর্থ আত্মসাতে আবুল খায়ের হিরু, তাঁর প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতব্বর, আব্দুল কাইয়ুম, মোনার্ক হোল্ডিংস, সাকিব আল হাসান, জাবেদ এ মতিন, সালমান এফ রহমান, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামসহ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত চার বছরে ডিএসই ১৮৪টি তদন্ত রিপোর্ট পাঠালেও বিএসইসি হিরুকে কয়েকটি কারসাজির মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানা করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন এবং একক সিদ্ধান্তে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০০ কোটি টাকার রূপান্তরযোগ্য বন্ড অনুমোদন দেন।
এসব বিষয়ে আবুল খায়ের হিরুর বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
৬১৯ কোটি টাকা জরিমানা, আদায় হয়নি এক কোটিও: কারসাজি রোধে তৎপর হওয়ার পাশাপাশি অতীতের অনিয়মের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএসইসি। গত পাঁচ মাসে কারসাজির দায়ে ৬১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হলেও এখনো এক টাকাও আদায় হয়নি।
বিএসইসি জানায়, আইন অনুযায়ী জরিমানার আদেশের পর অভিযুক্তদের ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশনের সুযোগ থাকে। রিভিউতে বহাল থাকলে তাঁরা হাইকোর্টে রিট করতে পারেন।
হিরুসহ জরিমানা আদায় ও ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে বিএসইসির পরিচালক মো. আবুল কালাম বলেন, কমিশন আগের জরিমানা বহাল রাখলে অভিযুক্তরা হাইকোর্টে রিট করতে পারেন। তবে জরিমানা আদায় না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট কেস করা হবে। কারসাজির বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা জীবন্ত লাশ হয়ে আছেন। বিএসইসি চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে বাজার থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা মূলধন উধাও হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে হতাশায় ভুগছেন, কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন। তাঁর মতে, বিএসইসি চেয়ারম্যান পুঁজিবাজার বোঝেন না, তাঁর নেতৃত্বে বাজারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণসহ পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্য নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরকারি মালিকানার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা, বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার করা এবং বড় ঋণের প্রয়োজন এমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহিত করা।
সৌজন্য কালেরকন্ঠ
শেয়ার করার বিকল্পগুলি
শেয়ার বাজার থেকে আরও
দরবেশের মুরিদ হিরু সিন্ডিকেটের কবলে পুঁজিবাজার, গায়েব ৮৫ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমআইএ)-এর দাবি, পুঁজিবাজারের ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন।
ডেইলি সান রিপোর্ট, ঢাকা
Published: ১৯ মে ২০২৫
শেয়ার করার বিকল্পগুলি
ছবি: সংগৃহীত
‘বড় হয়ে আমরা কেউ পুঁজিবাজারে যাব না। পুঁজিবাজারে গেলে মানুষ ফকির হয়’- এভাবেই প্রতিদিন চার সন্তানকে পড়ার টেবিলে শপথ করান আমিনা খাতুন। তাঁর স্বামী সাইফুল আলম, ধানমণ্ডির ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী, পুঁজিবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ও ফোর্সড সেলের কারণে সাইফুল আলমের মতো বহু বিনিয়োগকারী আজ নি:স্ব। অন্যদিকে, আবুল খায়ের হিরুর মতো কারসাজির মূলহোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুঁজিবাজারের ‘দরবেশ’ খ্যাত সালমান এফ রহমানের কারসাজির অন্যতম সহযোগী এই হিরুর কালো ছায়া যেন পুঁজিবাজার থেকে সরছেই না।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমআইএ)-এর দাবি, পুঁজিবাজারের ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন। সংগঠনটি আরও জানায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর বাজার মূলধন প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
লোটাস কামাল-দরবেশ-শিবলী রুবাইয়াতের সিন্ডিকেট: স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশের শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে সালমান এফ রহমান, লোটাস কামাল, শিবলী রুবাইয়াত ও আবুল খায়ের হিরু ছিলেন একে অপরের সহযোগী। তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কারসাজিতে সিএমসি কামালের সঙ্গে লোটাস কামালও জড়িত ছিলেন।
অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই জোটের কেউই শাস্তির মুখোমুখি হননি। ফলে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শেয়ারবাজারে সর্বনাশের পেছনে এই দুই জুটির কারসাজিই মূল কারণ। নিয়ম-কানুনকে উপেক্ষা করে তাঁদের অবাধ লুটপাট অব্যাহত থাকে। এই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নি:স্ব হয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী, লোপাট হয়েছে তাঁদের পুঁজি।
বিগত ১৫ বছরে শেয়ার কারসাজি ও জালিয়াতির আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে এসব নাম। বাজার কারসাজিতে সহায়তার জন্য তাঁরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়েছেন। এই চক্র সম্মিলিতভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।
দরবেশের মুরিদরা এখনো সক্রিয়: বিএসইসির অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির সদস্য ইয়াওয়ার সাঈদ বলেন, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে অনেক তথ্য বেরিয়ে এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। সেই ‘দরবেশ, পীররা’ বহাল তবিয়তে পুঁজিবাজার চালিয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা না থাকলেও তাঁদের অনুসারীরা এখনো সক্রিয় রয়ে গেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নাম যুগের পর যুগ ধরে পুঁজিবাজারের কারসাজির সঙ্গে সমার্থক হয়ে আছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েও তাঁর বিচার হয়নি। ১৯৯৬ সালের ভয়াবহ ধসের নেপথ্যে জুলাই থেকে ডিসেম্বরে জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সালমান এফ রহমান ও তাঁর কোম্পানি জড়িত ছিল বলে বিএসইসির তদন্তেও উঠে এসেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘদিন মন্দার কারণে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী বড় ধরনের লোকসানের মুখে। সালমানপন্থী একটি গোষ্ঠী বাজারে বিক্রির চাপ তৈরি করে পতন ত্বরান্বিত করছে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অস্থির হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৪২৬ পয়েন্টে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা আশার আলো দেখলেও, গত বছরের ১১ আগস্ট সূচকটি বেড়ে ৬০১৬ পয়েন্টে দাঁড়ালেও এরপর ফের পতন শুরু হয়। সর্বশেষ গত রবিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২৯.৩৮ পয়েন্ট কমে ৪৭৯১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনও তলানিতে, মাত্র ২৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। গত ৯ মাসে সূচকটি ১২২৫ পয়েন্ট হারিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে পুঁজিবাজারের দরপতন আরও তীব্র হচ্ছে।
কে এই হিরু: আবুল খায়ের হিরু শেয়ারবাজারে একজন আলোচিত সরকারি কর্মকর্তা, যিনি শেয়ার কারসাজি করে রাতারাতি বড় বিনিয়োগকারী বনে যান। সমবায় ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনি কোনো শেয়ার কিনলে অন্য বিনিয়োগকারীরাও তাঁকে অনুসরণ করেন, কারণ তাঁরা জানেন সেই বিনিয়োগ লাভজনক হবে।
সমবায় অধিদপ্তরের উপরেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরু নিজের নামে ও আত্মীয়-স্বজন, পরিবারের সদস্য এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নামে একাধিক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, শেয়ার দর কারসাজির প্রতিটি অভিযোগের শুনানিতে হিরু তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি জমা দিতেন।
সাবেক শিবলী কমিশনের সময়কালে আবুল খায়ের হিরু ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন। ডজনের বেশি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে বিএসইসি ২০২২ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে হিরু ও তাঁর সহযোগীদের জরিমানা করে। জরিমানা পরিশোধ না করায় তাঁদের বিরুদ্ধে চারটি মামলাও করা হয়েছে।
বিএসইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিরু ও তাঁর সহযোগীরা গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স, ঢাকা ইনস্যুরেন্স, এশিয়া ইনস্যুরেন্স, ফরচুন সুজ, ওয়ান ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, বিডিকম অনলাইন, আইপিডিসি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স, জেনেক্স ইনফোসিস, প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সসহ আরও কিছু কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িত ছিলেন।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা চলছে, তাই দরপতন হচ্ছে। মন্দা বাজারেও কারসাজি থামেনি। কারা কারসাজি করছে তা বিএসইসি ভালো জানে। ব্যবস্থা না নিলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারও কারও জড়িত থাকার সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে।
অভিনব উপায়ে কারসাজি: সর্বশেষ গত ১৫ মে পুঁজিবাজার কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবুল খায়ের হিরু ও তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ ১৩ জনের সিন্ডিকেটকে ২৯ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। সাকিবকে জরিমানা করা হয় দুই কোটি ২৬ লাখ টাকা।
বিএসইসির এপ্রিল মাসের ‘এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, জরিমানার সম্মুখীন হওয়া অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: কাজী সাদিয়া হাসান, আবুল কালাম মাতব্বর, ডিআইটি কো-অপারেটিভ, কাজী ফরিদ হাসান, কাজী ফুয়াদ হাসান, কনিকা আফরোজ, সাজেদ মাতব্বর, মোহাম্মদ বাশার, মোনার্ক হোল্ডিংস, মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, সফটাভিয়ন এবং জাভেদ এ মতিন।
বিএসইসির তদন্তে বলা হয়েছে, এই চক্রটি সোনালী পেপারের শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ১২৬ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৯৫৭.৭০ টাকায় পৌঁছায় এবং ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মুনাফা তোলে ও আরও ৫৫ কোটি টাকার অবাস্তবায়িত লাভের সম্ভাবনা তৈরি করে। হিরু কমিশনের কাছে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে সাকিবের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে শেয়ার লেনদেনে আরও সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
এর আগে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর কারসাজির দায়ে হিরু, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানকে ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতব্বরকে সর্বোচ্চ ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, হিরুকে ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ২৭ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তেও শেয়ারবাজারে কারসাজি ও অর্থ আত্মসাতে আবুল খায়ের হিরু, তাঁর প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতব্বর, আব্দুল কাইয়ুম, মোনার্ক হোল্ডিংস, সাকিব আল হাসান, জাবেদ এ মতিন, সালমান এফ রহমান, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামসহ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত চার বছরে ডিএসই ১৮৪টি তদন্ত রিপোর্ট পাঠালেও বিএসইসি হিরুকে কয়েকটি কারসাজির মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানা করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন এবং একক সিদ্ধান্তে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০০ কোটি টাকার রূপান্তরযোগ্য বন্ড অনুমোদন দেন।
এসব বিষয়ে আবুল খায়ের হিরুর বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
৬১৯ কোটি টাকা জরিমানা, আদায় হয়নি এক কোটিও: কারসাজি রোধে তৎপর হওয়ার পাশাপাশি অতীতের অনিয়মের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএসইসি। গত পাঁচ মাসে কারসাজির দায়ে ৬১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হলেও এখনো এক টাকাও আদায় হয়নি।
বিএসইসি জানায়, আইন অনুযায়ী জরিমানার আদেশের পর অভিযুক্তদের ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশনের সুযোগ থাকে। রিভিউতে বহাল থাকলে তাঁরা হাইকোর্টে রিট করতে পারেন।
হিরুসহ জরিমানা আদায় ও ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে বিএসইসির পরিচালক মো. আবুল কালাম বলেন, কমিশন আগের জরিমানা বহাল রাখলে অভিযুক্তরা হাইকোর্টে রিট করতে পারেন। তবে জরিমানা আদায় না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট কেস করা হবে। কারসাজির বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা জীবন্ত লাশ হয়ে আছেন। বিএসইসি চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে বাজার থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা মূলধন উধাও হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকে হতাশায় ভুগছেন, কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন। তাঁর মতে, বিএসইসি চেয়ারম্যান পুঁজিবাজার বোঝেন না, তাঁর নেতৃত্বে বাজারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণসহ পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্য নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরকারি মালিকানার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা, বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার করা এবং বড় ঋণের প্রয়োজন এমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহিত করা।
সৌজন্য কালেরকন্ঠ



