Logo
×

Follow Us

শেয়ার বাজার

৩৯ বছর পর

চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা

চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭২টি ক্যাটাগরির মধ্যে ১৬৮টিতে ট্যারিফ (মাশুল) বাড়ানো হয়েছে।

ডেইলি সান রিপোর্ট, চট্টগ্রাম

Published: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

শুনুন | ৮:৪৮ মিনিট

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন সেবার মাশুল ৩৯ বছর পর ৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বর্ধিত মাশুল গত রবিবার থেকে কার্যকর করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মোট বাণিজ্যের ৯৩ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে এই মাশুল বাড়ানোয় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় প্রভাব পড়বে। তাতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭২টি ক্যাটাগরির মধ্যে ১৬৮টিতে ট্যারিফ (মাশুল) বাড়ানো হয়েছে। গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশের ওপর ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন ট্যারিফ কাঠামো অনুযায়ী, প্রতি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনার থেকে আদায়কৃত গড় মাশুল ১১ হাজার ৮৪৯ ৮৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। এতে প্রতি কনটেইনারে গড়ে অতিরিক্ত চার হাজার ৩৯৫ টাকা দিতে হবে, এ ক্ষেত্রে মাশুল বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৭%। এ ছাড়া আমদানি কনটেইনারের ক্ষেত্রে মাশুল বেড়েছে পাঁচ হাজার ৭২০ টাকা, রপ্তানি কনটেইনারের ক্ষেত্রে বেড়েছে তিন হাজার ৪৫ টাকা। এই খাতে প্রতি কনটেইনার ওঠানো বা নামানোর খরচ ৪৩.৪০ থেকে বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে, যা ২৪.৬০ ডলার বেশি।

এটি একটি বড় বৃদ্ধির খাত। নতুন মাশুল কার্যকর হওয়ায় প্রতি কেজি কনটেইনার পণ্যে অতিরিক্ত ৪৭ পয়সা দিতে হবে, যা আগে ছিল এক টাকা ২৮ পয়সা।

কনটেইনারের পাশাপাশি কনটেইনার জাহাজের বিভিন্ন সেবার মাশুলও বাড়ানো হয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার জাহাজের বন্দরের প্রবেশ ফি চার হাজার ৩৬২ ডলার থেকে বেড়ে ছয় হাজার ৮৩৪ ডলারে উন্নীত করা হয়েছে, যা বেড়েছে ৫৬ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া পাইলটেজ চার্জ প্রায় ৯৬ শতাংশ ও লোডিং-আনলোডিং চার্জ ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এ ছাড়া গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনও তাদের মাশুল ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাছাকাছি অতিরিক্ত খরচ বাড়াবে।

জানা যায়, বর্তমানে ১৯৮৬ সালের ট্যারিফ কাঠামো অনুযায়ী সেবার মূল্য নিচ্ছে বন্দর। সর্বশেষ ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে পাঁচটি খাতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে পুরো ট্যারিফ কাঠামোই যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। সে সময় এতে সায় না দিলেও ২০১৯ সালে সরকার ট্যারিফ বাড়ানোর অনুমোদন দিলে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে বন্দর। ২০২০ সালে নতুন সেবা মূল্যের প্রস্তাবনা দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরপর এবার এটি কার্যকর করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আয় ছিল পাঁচ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং খরচ ছিল দুই হাজার ৩১৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এতে তাদের মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ৯১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দুই হাজার ৭১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা মুনাফার তুলনায় এটি ৭.২৭% বেশি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘৩৯ বছর পর এভাবে চার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশপাশের দেশের তুলনায়ও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনারপ্রতি চার্জ এখনো অনেক কম। যেমন—এক টিইইউসের (২০ ফুট কনটেইনারের একক) আনলোডিং চার্জ কলম্বোতে ১০০ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার। আর চট্টগ্রামে এটি মাত্র ৪৩.৪০ ডলার। এর আগেও একাধিকবার চার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে তা বারবার পেছানো হয়।’

চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার ও মেরিন সদস্য ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ বলেন, ‘বন্দরের পক্ষ থেকে জাহাজ আসার পর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তার বিপরীতে বিভিন্ন রকম চার্জ হয়, যেমন-টার্গেট চার্জ, ওয়াটার চার্জ, ওয়ারফ্রেন্ট চার্জ। আমাদের প্রতিবেশী যেমন শ্রীলঙ্কা বা অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ রেট কম। আমাদের ট্যারিফ রেট যদি সবার সঙ্গে সমানও রাখতে চাই, তাহলে এটা বাড়ানোটা যৌক্তিক।’

এই মাশুল বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীরা খরচ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমএসসি শিপিং লাইনের মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, এটা একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রত্যেক আইটেমকে আনজাস্টিফায়েডভাবে এত বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে, যা ট্রেডের জন্য এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর।’

আমদানিকারক ও রাশেদ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আক্তার হোসেন জানান, ‘গত মার্চেই বন্দরের স্টোরেজ ভাড়া চার গুণ বেড়েছে। কাস্টমস জটিলতায় কনটেইনার প্রায়ই ১০ থেকে ১৫ দিন পড়ে থাকে, যেখানে ফ্রি উইন্ডো মাত্র চার দিন। এতে দৈনিক প্রতি কনটেইনারে ৪৮ ডলার খরচ হয়, যা আমাদের মুনাফার মার্জিনে বড় চাপ তৈরি করছে। এখন বন্দরের চার্জ বাড়ায় তার ভার ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে। আমাদের পক্ষে আর খরচ সামলানো সম্ভব নয়।’

তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘অফডকগুলো তাদের চার্জ বাড়িয়েছে। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ বাড়িয়েছে। পরিবহন খাতের শ্রমিকরাও তাঁদের মজুরি বাড়াচ্ছেন। আর এসব দেখে শিপিং কম্পানিগুলো তাদের চার্জ বাড়িয়ে দেবে। সবাই যদি শুধুই চার্জ বাড়ায় তাহলে আমরা ব্যবসায়ীরা কিভাবে ব্যবসা করব?’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘২০০৮ সালে যখন ডলারের দাম ছিল ৭৬ টাকা, তখন আমাদের যেই রেটটা করেছে এখন আছে ১২০ টাকা। অর্থাৎ যতবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, ততবার বন্দরের রেট বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বাড়ালে কস্ট অব ডুয়িং ভিজিলেন্স বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে এবং আমাদের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, ‘শিপিং কম্পানিগুলো তাদের ফ্রেড আইটেমের মধ্যে এই রেটগুলো বাড়িয়ে দেবে। ফলে এগুলো ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়বে।’

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খাইরুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর চাইলে ধাপে ধাপে ট্যারিফ বাড়াতে পারত। একসঙ্গে সব সেবার বিপরীতে ট্যারিফ বৃদ্ধির ধাক্কা ব্যবসায়ীরা সামাল দিতে পারবেন না। এর খেসারত দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের।

মন্তব্য করুন

আরও পড়ুন