Logo
×

Follow Us

শিল্প

অবৈধ গ্যাস বিক্রি

ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে ভরে শিল্পকারখানায় সরবরাহ, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি

প্রতি ঘনমিটার সিএনজির সরকারি দাম ৪৩ টাকা হলেও, অবৈধভাবে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ডেইলি সান রিপোর্ট, ঢাকা

Published: ০৯ মে ২০২৫

ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে ভরে শিল্পকারখানায় সরবরাহ, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি

সাভার ও গাজীপুরে দুটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে কাভার্ডভ্যান ও ভ্যানে করে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা। ছবি: সংগৃহীত

শুনুন | ৮:৪৮ মিনিট

সিএনজি (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রির এক বিপজ্জনক চিত্র উঠে এসেছে।

নিয়মানুযায়ী, সিএনজি স্টেশন থেকে শুধুমাত্র যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ করার কথা থাকলেও, এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যানবাহনের জন্য নির্ধারিত গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে ভ্যান, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের শিল্প-কারখানা ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবৈধ গ্যাস সরবরাহ প্রক্রিয়া যেকোনো সময় বড় ধরনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনে, যানবাহনের চালকরা গ্যাসের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করলেও অনেক স্টেশনে তাদের গ্যাস সরবরাহ না করে কারখানার সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানগুলোতে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকার সিএনজি স্টেশনগুলোতে এই অবৈধ গ্যাস সরবরাহের ঘটনা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক সিএনজি স্টেশন মালিক গ্যাসের সংকটের অজুহাত দেখিয়ে যানবাহনকে গ্যাস সরবরাহ না করে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভ করছেন। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির সরকারি দাম ৪৩ টাকা হলেও, অবৈধভাবে এসব গ্যাস সিলিন্ডারে প্রতি ঘনমিটার ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

সিএনজি স্টেশন মালিকদের দাবি, বর্তমানে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় ছোট উদ্যোক্তারা তাদের কারখানার উৎপাদন সচল রাখতে বাধ্য হয়ে বিকল্প উপায়ে ফিলিং স্টেশন থেকে গ্যাস সংগ্রহ করছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা এই প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে অবৈধভাবে রিফুয়েলিংয়ের জন্য সরবরাহ করা সিএনজি ভর্তি সিলিন্ডারগুলো এক একটি ভ্রাম্যমাণ বোমার মতো। আগে গভীর রাতে গোপনে এই কার্যক্রম চললেও, বর্তমানে দিনরাত ওপেন সিক্রেটভাবে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান ভর্তি গুচ্ছ সিলিন্ডারের মাধ্যমে সিএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে, যা চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘অবিলম্বে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস রিফিল বন্ধ করা উচিত। কারণ এটি মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বিইআরসি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা উচিত। যেসব সিএনজি পাম্প বিইআরসির শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে গ্যাস সরবরাহ করছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। তারা সিএনজি পাম্প পরিচালনার যোগ্য নয়।’

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)-এর চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ এই অবৈধ কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বিতরণ কোম্পানি, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহিত করা হবে। একই সাথে অবৈধ গ্যাস সরবরাহকারী সিএনজি স্টেশনগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’

দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, সিএনজি পাম্পগুলো থেকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস নিয়ে শিল্পে সরবরাহ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী এটি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দেখার বিষয়, তিতাস গ্যাসের নয়।

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারে মজুদ ও পরিবহনকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, সিলিন্ডারে উচ্চ চাপে গ্যাস থাকে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার ও নরসিংদী এলাকায় এই অবৈধ কাজ বেশি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিস্ফোরক পরিদপ্তর দ্রুত এই বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবে এবং জেলা প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

গাজীপুর: গাজীপুরের দু-একটি স্টেশন ছাড়া প্রায় সব স্টেশনেই সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। যানবাহনের দীর্ঘ লাইন থাকলেও সেগুলোকে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে না। অনেক সময় গ্যাস দিলেও তাতে পর্যাপ্ত প্রেসার থাকে না। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তে স্টেশন বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও, অনেক স্টেশন তা অমান্য করে কারখানার কাছে কাভার্ড ভ্যানে গ্যাস বিক্রি করছে।

সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকার কেআরসি সিএনজি স্টেশনে ভালুকার সীডস্টোর এলাকার এক্সিলেন্ট সিরামিক কারখানার গ্যাসবাহী কাভার্ড ভ্যান ভর্তি করা হচ্ছিল। ওই কারখানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় কারখানার উৎপাদন চালু রাখতে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস নিতে হয়। কাভার্ড ভ্যানটি ছোট হওয়ায় গ্যাস ভরতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।

সাভার: সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল, জামগড়া, জিরাবো, পুকুরপারসহ বিভিন্ন এলাকার সিএনজি স্টেশনগুলোতেও প্রকাশ্যে ও গোপনে রিকশা, ভ্যান ও কাভার্ড ভ্যানে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ করার তথ্য পাওয়া গেছে। এই গ্যাস কারখানাগুলোর বয়লার ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়।

টিএস সিএনজি রিফুয়েলিং অ্যান্ড কনভারশন লিমিটেড পাম্পের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান জানান, সরকারি অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় কারখানা মালিকদের অনুরোধ এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি পাম্পেই কমবেশি এই অবৈধ কার্যক্রম চলছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

এই পরিস্থিতিতে অবৈধ গ্যাস সরবরাহ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

মন্তব্য করুন

আরও পড়ুন