Logo
×

Follow Us

শিল্প

শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানিতে ফাঁকি, হুমকির মুখে দেশীয় কাগজশিল্প

কাগজ আমদানির এই সুযোগে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

ডেইলি সান রিপোর্ট, ঢাকা

Published: ১৫ মে ২০২৫

শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানিতে ফাঁকি, হুমকির মুখে দেশীয় কাগজশিল্প

ছবি: সংগৃহীত

শুনুন | ৮:৪৮ মিনিট

শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধার সুযোগ নিয়ে বিদেশ থেকে পাঠ্যপুস্তকের কাগজ আমদানিতে একটি অসাধু চক্র ফায়দা লুটছে। মুদ্রণশিল্পের কাঁচামালের এই সুবিধা পাওয়া কাগজ খোলাবাজারে বিক্রির সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, বেশি মুনাফার লোভে তা বিক্রি করছে চক্রটি। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় কাগজশিল্প।

কাগজ আমদানির এই সুযোগে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। সম্প্রতি বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে।

বিপিএমএ জানিয়েছে, দেশীয় কাগজকলগুলোর যথেষ্ট উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় বাংলাদেশের কাগজশিল্প হুমকির মুখে। তারা ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির বিশেষ সুবিধা বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। 

সংগঠনটি এনবিআরকে জানিয়েছে, ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগসাজশে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকের জন্য শুল্কমুক্ত আমদানি করা সাত হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কাগজ মুদ্রণকারীদের কাছে সরবরাহ না করে বেশি লাভের জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করেছে। এমনকি নথিপত্রের বাইরে আরও বেশি কাগজ আমদানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিপিএমএ বলছে, এই অসাধু চক্র একদিকে শুল্কমুক্ত আমদানির শর্ত ভেঙেছে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছে। অথচ দেশীয় মিলগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজ সরবরাহ করতে সক্ষম। এই অবস্থায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি দেশীয় কাগজশিল্পের জন্য বড় হুমকি।

কাগজ উৎপাদন শিল্প জানায়, এই অশুভ চক্রান্ত এখনই বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও অনেকে উৎসাহিত হবে। বিপিএমএ এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার এবং সরকারের রাজস্ব ক্ষতি আদায়ের দাবি জানিয়েছে।

এনবিআরের আগে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছেও বিষয়টি জানিয়েছে বিপিএমএ। তারা শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বন্ড সুবিধার মতো শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার করছে, যা বৈশ্বিক মন্দায় ধুঁকতে থাকা দেশীয় কাগজশিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সুবিধা অব্যাহত থাকলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

বিপিএমএ অন্য এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়, শুল্কমুক্ত ছাপার কাগজ আমদানির সুযোগ বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে ছাপার কাগজের ওপর আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য সিডি ও আরডি মওকুফ করায় দেশীয় কাগজশিল্প খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পারস্পরিক যোগসাজশে বন্ড সুবিধার মতো আলোচ্য শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার করছে। বৈশ্বিক মন্দায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন করার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়েছে।

শুল্কমুক্ত সুবিধায় এরই মধ্যে আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। বিশেষ মহল ভবিষ্যতেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করবে। এই অযৌক্তিক সুবিধা অব্যাহত থাকলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাগজশিল্প আমদানি বিকল্প, রপ্তানিমুখী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

দেশে নিবন্ধিত ১২৮টির মধ্যে  স্থাপিত ১০৬টি পেপার মিলের বছরে ১৬ লাখ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে ৯ লাখ মেট্রিক টন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কাগজ ৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে। এতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল।

দেশীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা এই খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। এই খাত প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দিয়ে আসছে। আমদানি বিকল্প শিল্প হিসেবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে।  দেশের কাগজশিল্পের যাত্রা অনেক দিনের হলেও বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের অসাধু কর্মকাণ্ডে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। বর্তমানে এই শিল্প এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মহল পারস্পরিক যোগসাজশে বিদ্যমান উদার নীতির অপপ্রয়োগ তথা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার, মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে। ফলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এরই মধ্যে ৮০টি কাগজ মিল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে এবং অবশিষ্ট ২৬টি মিল কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

প্রসঙ্গত এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কাগজ সঠিক মূল্যে যথাসময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করার সক্ষমতা বিপিএমএর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে। ২০ বছর ধরে এনসিটিবি সরাসরি কেনা কাগজ দেশীয় মিলগুলো নির্ধারিত গুণগতমান অনুযায়ী এবং এনসিটিবির সব শর্ত পরিপালন করে সরবরাহ করে আসছে। অথচ এনসিটিবির কার্যাদেশ পাওয়া মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় মিলের কাগজ না কিনে বিনাশুল্কে ছাপার কাগজ আমদানি করছে। এই ক্ষেত্রে এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত দেশীয় কাগজশিল্পের জন্য আত্মঘাতী।

এ ছাড়া দেশীয় মিলগুলোর উৎপাদিত কাগজ এনসিটিবিতে সরবরাহের জন্য ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। অথচ আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থানীয় ও আমদানিকৃত কাগজের মধ্যে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। 

এ অবস্থায় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা দেশীয় কাগজশিল্প খাত ও এর সঙ্গে নির্ভরশীল প্রায় ৩০০টি লিংকেজ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা এবং এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ সুরক্ষায় শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে। 

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাগজ আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক শর্তসাপেক্ষে মওকুফ করা হয়। কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফ সুবিধা নিলেও অনেকেই শর্ত মানছে না।

 

মন্তব্য করুন

আরও পড়ুন