Logo
×

Follow Us

শিল্প

এশিয়ার পোশাক সাম্রাজ্যের মোগল কে এই কিহাক সাং

কিহাক সাংকে বলা হয় ‘এশিয়ার পোশাক সাম্রাজ্যের মোগল’। তার হাত ধরে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবন ঘটেছে।

ডেইলি সান রিপোর্ট

Published: ১০ এপ্রিল ২০২৫

এশিয়ার পোশাক সাম্রাজ্যের মোগল কে এই কিহাক সাং

ছবি: সংগৃহীত

শুনুন | ৮:৪৮ মিনিট

গত ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশ ও এর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং। দেশের শিল্প খাত বিকাশে বিশেষ অবদান রাখায় ‘সম্মানসূচক নাগরিকত্ব সনদ’ পেয়েছেন কোরিয়ান এ নাগরিক। বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদান রাখায় বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও ‘সম্মানিত নাগরিক’ এর মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। তিনি ‘এশিয়ার পোশাক সাম্রাজ্যের মোগল’ হিসেবেই অধিক পরিচিত। নিজের ৭৮ বছর জীবনের অর্ধেকের বেশিই তিনি জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের সঙ্গে। চলুন জেনে নেয়া যাক কে এই কিহাক সাং, কেনই বা পেলেন রাষ্ট্রীয় এ সম্মাননা?

কিহাক সাংকে বলা হয় এশিয়ার পোশাক সাম্রাজ্যের মোগল। তার হাত ধরে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত বাজারগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি সিনথেটিক ফেব্রিক্সের যে জ্যাকেটের বাজার বা চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেটির পথপ্রদর্শক ছিলেন কিহাক সাং। কিহাক সাং বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও অন্যতম। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। কিহাক সাং বাংলাদেশের শিল্পের সঙ্গে যে তার যাত্রা শুরু করেছিলেন, এখন তা এক শিল্প সামাজ্যে রূপ নিয়েছে।

নিজের ৭৮ বছর জীবনের অর্ধেকের বেশিই তিনি জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের সঙ্গে। আশির দশকে এ দেশের পোশাক শিল্পের যাত্রার শুরুতে তিনি ছিলেন এই শিল্পের যাত্রাসঙ্গী। তা-ও আবার হাতে-গোনা কয়েকজনের মধ্যে একজন। শুধু তা-ই নয়, আশির দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশের শিল্পের সঙ্গে সেই যে তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন, এখন তা এক শিল্প সামাজ্যে রূপ নিয়েছে।

গত ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশ ও এর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং, পেলেন অন্য রকম এক স্বীকৃতি। বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিকাশ ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয়ের অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয়েছে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব (অনারারি সিটিজেনশিপ)। চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী দিনে তাঁর হাতে এই স্বীকৃতি তুলে দেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এর মাধ্যমে একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি পেলেন এ দেশের নাগরিক না হয়েও ‘সম্মানিত নাগরিক’ মর্যাদা।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে যারা তাকে এই সম্মাননা দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত ও সহজ করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পথচলা নিরাপদ ও মসৃণ করাও জরুরি। সেই সঙ্গে তাদের যথাযথ স্বীকৃতি ও সম্মাননা দিতে পারলে অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তাতে সম্মানিত বোধ করবেন।

এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডা। সংস্থাটি এ দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ‘বিনিয়োগ অ্যাম্বেসেডর বা বিনিয়োগ দূত’ হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চায়। এ জন্য ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে এ দেশের বিনিয়োগ দূতের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেয় তারা। বিডা মনে করছে, কিহাক সাংয়ের হাত ধরে এ দেশে কোরীয়সহ বিশ্বের আরও অনেক বিনিয়োগকারীর বড় ধরনের বিনিয়োগ আসবে বা আনতে কাজ করবেন।

বিডার এই ভাবনা যে একেবারে অমূলক নয়, তার প্রমাণও এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে কোরিয়ার আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধি দল এসেছে। ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং নিজ উদ্যোগে কোরিয়া থেকে এসব বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশ সফরে নিয়ে এসেছেন। সফরকারী কোরিয়া বিনিয়োগকারীদের দলটি গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

কোরিয়ান নাগরিক কিহাক সাংয়ের যাত্রাটা ছিল খুবই সাধারণ মানের। কোরিয়ায় তাঁর বাবার ছিল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসা। তরুণ বয়সেই কিহাক ঠিক করেন, কর্মজীবনে তিনি বাবার সেই ব্যবসায় যোগ দেবেন না। শিক্ষাজীবন শেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথা অনুযায়ী, তিনি দেশটির সেনাবাহিনীতে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মাত্র ২৫ বছর বয়সে কর্মজীবন শুরু করেন দেশটির একটি পোশাক কারখানায় বিক্রয় নির্বাহী হিসেবে। বিক্রয় নির্বাহী হিসেবে পোশাক খাতে কাজ করতে গিয়ে এ খাতের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে যান। কাজের সূত্রে পরিচয় হয় বিদেশি অনেক ক্রেতার সঙ্গে, জানতে পারেন খুঁটিনাটি নানা বিষয়। সেই যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতাকেই পরে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে লাগান।

কিহাক সাং ৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আসেন। সে সময় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী। চট্টগ্রামে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এদেশে বিনিয়োগ এবং তৈরি পোশাক খাতে কার্যক্রম শুরু করেন। তখন থেকেই দেশের অর্থনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প খাতের বিকাশ ও বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয়ে রয়েছে তার বড় অবদান। চট্টগ্রাম ইপিজেডের বৃহত্তম কারখানা ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন ছাড়াও আনোয়ারায় তিনি গড়ে তুলেছেন কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা কেইপিজেড। সেখানে তার ইয়াংওয়ানের ৪৮টি কারখানা রয়েছে। বর্তমানে কিহাক সাংয়ের হাতে গড়া ইয়াংওয়ার করপোরেশনের বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় ৭৩ হাজারের বেশি লোক কাজ করেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৮৬ কোটি ২৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ইয়াংওয়ান করপোরেশন। এর মধ্যে ছিল ৮০ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পোশাকপণ্য। পোশাকের বাইরে জুতা, ব্যাগসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাকি ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। বাংলাদেশ থেকে ইয়াংওয়ানের প্রায় ৮৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে ৩৮ কোটি ডলারই এসেছে কেইপিজেড থেকে।

চট্টগ্রামের কেইপিজেড পরিচালিত হয় ইয়াংওয়ান করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে। তাই এই ইপিজেডের সিংহভাগ কারখানাও ইয়াংওয়ানের। তাদের রয়েছে ৪৮টি কারখানা। এর বাইরে বিদেশি দুই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ভাড়াভিত্তিক দুটি কারখানা রয়েছে।

শুধু কারখানা গড়ে তোলার মধ্যে নিজেদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখেনি ইয়াংওয়ান গ্রুপ। কেইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ১০০ শয্যার হাসপাতাল। নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে ৬০০ শয্যার হাসপাতাল ও টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট। এ ছাড়া আগামীতে এই ইপিজেডে আরও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা হবে বলে জানান ইয়াংওয়ানের কর্মকর্তারা। এত দিন সেটি সম্ভব হয়নি কেইপিজেডের জমি–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারিতে কেইপিজেডের জমি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হয়। ফলে এই শিল্পনগরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের দুয়ারও খুলে গেছে বলে জানান ইয়াংওয়ানের কর্মকর্তারা।

ইয়াংওয়ান-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সাতটি দেশে কারখানা রয়েছে ইয়াংওয়ান করপোরেশনের। বাকি ছয়টি দেশ হলো ভারত, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, উজবেকিস্তান, এল সালভাদর ও কোরিয়া। এই সাতটি দেশের সব কারখানা মিলিয়ে ইয়াংওয়ানে কাজ করেন ৯৫ হাজার লোক। সারা বিশ্বে ইয়াংওয়ান করপোরেশনের যে ব্যবসা, তার ৭০ শতাংশই বাংলাদেশে। এ কারণে সিংহভাগ কর্মসংস্থানও হয়েছে এই দেশের কারখানাগুলোতে।

ইয়াংওয়ান করপোরেশন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি। ১৯৮৮ সালে এটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার ছাড়ে কোরিয়ার বাজারে। সিউল স্টক এক্সচেঞ্জে দেওয়া কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইয়াংওয়ান করপোরেশন বিশ্বজুড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি উয়নের (কোরিয়ান মুদ্রা) ব্যবসা করেছে। প্রতি উয়ন বাংলাদেশের ৮১ পয়সার সমমানের। সেই হিসাবে বাংলাদেশের মুদ্রায় ২০২৩ সালে ইয়াংওয়ানের ব্যবসার পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকার।

মন্তব্য করুন

আরও পড়ুন